logo corona

নারী স্বাধীনতা ।। রোশেনারা খান

swadhinota 

স্বাধীনতা বলতে কী বোঝায় ? এর উত্তর  বা সংজ্ঞা সমাজের বিভিন্ন  শ্রেণির নারী-পুরুষের কাছে বিভিন্ন রকম। আসলে বহু যুগ ধরে পুরুষ ও পুরুষ-তান্ত্রিক  সমাজব্যবস্থায় ধর্মের নামে নারীকে  সামাজিক রীতি-নিয়মের বেড়াজালে  আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে গৃহবন্দি করে রাখার পক্ষপাতদুষ্ট রেওয়াজ চলে আসছে। নারীকে অবদমিত করে রাখার মধ্যে পুরুষের পৌরুষের দম্ভ প্রকাশ পায়। তবে আমাদের দেশে আদি যুগে এমনটা ছিলনা। 

   শ্রুতি যুগে ভারতীয় মহিলাদের নানা ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ছিল। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে নানা বিষয়ে শিক্ষা লাভ করত। তাদের স্বামী নির্বাচন করার স্বাধীনতা ছিল। মহিলা হয়েও তাদের যজ্ঞ করার স্বাধীনতা ছিল। পরবর্তী কালে, মানে স্মৃতি যুগে মনু নারীর সব স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে তাদের গৃহবন্দি করে রাখার নির্দেশ দেন। পাঁচ বছরের মেয়েও যখন তখন নিজের বাবার সামনে বের হতে পারত না। বাল্যবিবাহের ফলে মেয়েদের শিক্ষা-দীক্ষা বন্ধ হয়ে গেল। এভাবেই  ধীরে ধীরে নারী সমাজ পুরুষদের থেকে ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে লাগল। বুদ্ধের সময়ে ভারতীয় নারী কিছুটা স্বাধীনতা পেয়ে থাকলেও পরবর্তী কালে আবার তাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়। শুধু তাই-ই নয়, ধর্মের নামে ক্রমশ নারীর জীবনকে নানারকম   নির্মম বিধিনিষেধের নাগপাশে বন্দী করে ফেলা হয়।  বিশেষ করে বিধবা  মহিলাদের  ওপর চলতে থাকে অমানুষিক নির্যাতন। তাদের মানুষ হিসেবেই গণ্য করা হত না। মধ্যযুগে সবচেয়ে বেশি মহিলারা তাদের অধিকার, পক্ষান্তরে স্বাধীনতা হারিয়েছে। মুসলিমদের মতো হিন্দু মহিলাদের মধ্যেও পর্দা প্রথার প্রচলন শুরু হয়। মেয়েদের বাড়ির বাইরে বেরিয়ে সবরকম শিক্ষা লাভ করা বন্ধ করে দেওয়া  হয়েছিল। প্রসঙ্গত জানাই জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের মহিলাদের পালকিসহ  ডুবিয়ে গঙ্গাস্নান করানো হত। প্রচার করা হত, মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে অল্প বয়সে বিধবা  হবে, তাদের জরায়ুর বিকৃতি ঘটবে। তারা কোন দিনও পুত্র সন্তানের জন্ম দিতে পারবে না। স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে সহমরণে পাঠানো তো ছিলই,  এছাড়াও নানা ধরনের যুক্তিহীন প্রথার প্রচলন করা হয়েছিল। বিধবার সম্পত্তি কেড়ে নেওয়ার জন্য তাকে বাড়িতে থাকতে না দিয়ে সামান্য মাসোহারার  পরিবর্তে কাশী পাঠিয়ে দেওয়া হত। তারপর ধীরে ধীরে মাসোহারা বন্ধ করে দিয়ে তাদের ভিক্ষা  করতে বাধ্য করা হত। কেরালায় এক শ্রেণির জনজাতি মহিলাদের প্রকাশ্য স্থানে স্তন ঢেকে রাখার জন্য , স্তনের আকার অনুযায়ী কর দিতে হত। কর প্রধানরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়েদের থেকে কর আদায় করত। ১৯২৪ সাল পর্যন্ত এই কর চালু ছিল। তবে কেউ কেউ বলেন বর্ণ হিন্দুদের সম্মান জানাতেই নাকি নিম্ন বর্ণের বা অস্পৃশ্য মহিলাদের স্তন খুলে রাখতে হত। মনু এস পিল্লাই ও আরও কয়েকজন পণ্ডিতের মতে কর একটা দিতে হত ঠিকই, তবে তার সঙ্গে স্তনের আকার বা স্তন ঢেকে রাখার কোন সম্পর্ক ছিলনা। তবে এই মত যে সবাই বিশ্বাস করেন , তা  কিন্তু নয়। সেই সময় গৌরীদান প্রথা ছিল। নরকবাস থেকে বাঁচতে অনেকেই আট বছরের মেয়ের সঙ্গে আশি বছরের বৃদ্ধের বিয়ে দিতে বিন্দু মাত্র কুণ্ঠা বোধ করতেন না। কিছুদিন পর স্বাভাবিক ভাবেই মেয়েটি বিধবা হত। স্বামী কী ? সে তা জানলনা অথচ তাকে জীবনভর বৈধব্যের নির্মম আচার মেনে চলতে হত।
        ব্রিটিশ শাসনকালে ইংরেজ সরকারের  সহযোগিতায়  সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আরও কিছু মুক্ত চিন্তার মানুষ ভারতীয় মহিলাদের বেশকিছু ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। সতীদাহ প্রথা আইন করে বন্ধ করা হয়েছিল। ফলে কিছু মহিলা বেঁচে থাকার স্বাধীনতা পেয়েছিলেন। আইন করে নারী ও পুরুষের বিবাহের সর্বনিম্ন বয়স বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। যদিও আজও মেয়েদের বাল্যবিবাহ প্রথা নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। তবে এক্ষেত্রে সরকারি প্রচেষ্টা জারি আছে। বিভিন্ন সময়ে নারী পুরুষের বিবাহের সর্বনিম্ন বয়স বাড়ানো হয়েছে। তবু  বিবাহে নিজস্ব মত প্রকাশের স্বাধীনতা  সমাজের সব শ্রেণির নারী আজও পায়নি।
  বহু সংগ্রামের ও বিবর্তনের ফলে আজ নারী অনেকাংশে স্বাধীনতা পেয়েছে ঠিকই , কিন্তু মানুষ তাদের সুবিধা মতো নারী স্বাধীনতার অর্থ বা সংজ্ঞা নির্ধারণ করে চলেছে। স্বাধীনতা পেতে পেতে কেউ কেউ কবে যে তাকে সেচ্ছাচারিতায় নিয়ে চলে  গেছে, তা তারা জানেই না। জানলেও তা স্বীকার করে না। আবার আর এক শ্রেণির নারী জানেই না, নারী স্বাধীনতা কাকে বলে? কী কী ক্ষেত্রে তারা স্বাধীনতা পেতে পারে।অত্যাধুনিক মহিলারা যদি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বনির্ভর হন, বা না হন তাঁরা অনেকেই থামতে শেখেননি। ফলে জীবনে এবং সংসারে নেমে আসে অবাঞ্ছিত অশান্তি । এদের কাছে স্বাধীনতা মানে সাংসারিক জীবনকে উচ্ছন্নে পাঠিয়ে পার্টি, ক্লাব, শপিং ইত্যাদি নিয়ে মেতে থাকা, অর্ধ উলঙ্গ পোশাক পরে বাইরে ঘোরা । সবথেকে লজ্জার এবং দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, মেয়েদের পোশাক নিয়ে বলতে গেলে বহু নারীবাদী ফোঁস করে ওঠেন। এরা পরিবারের অর্থ বোঝেনা। টাকা বোঝে। টাকা দিয়ে বাড়িতে কাজের লোক, রান্নার লোক রাখা যায়, বাচ্চার জন্য আয়া গৃহশিক্ষক রাখা যায়। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য টাকার প্রয়োজন ঠিকই, তার মানে এই নয় যে টাকার বিনিময়ে সব পাওয়া যায়। একটি পরিবারের জন্য শ্রদ্ধা ,ভালবাসা, স্নেহ, মমতার অত্যন্ত প্রয়োজন, এগুলোই সম্পর্কগুলোকে বেঁধে রাখে। এগুলো ধীরে ধীরে পরিবার থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বলেই তুচ্ছ কারণে সংসার ভাঙছে । এতে  সব থেকে বেশি ক্ষতি হচ্ছে শিশু সন্তানের ও বৃদ্ধ বাবা মায়ের। সন্তানকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে হস্টেলে, আর বৃদ্ধ বাবা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে। ভারতীয় সমাজের যে  পারিবারিক বন্ধন, তা ক্রমশ এভাবেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। 
   আর এক শ্রেণির মহিলা আছে, যারা পুরোপুরি পুরুষনির্ভর হওয়ার কারণে জানেইনা ‘নারী স্বাধীনতা’ কী? পুরুষদের প্রদেয় নির্ধারিত গণ্ডির মধ্যে থেকে এরা নিরাপদ বোধ করে। ‘যা কিছু হোক মাথায় আছেন পরমগুরু স্বামী’। এই পুরুষ  নির্ভরতার কারণে এদের যে শুধু নিজের বিষয়ে বা পারিবারিক কোন বিষয়ে  সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা নেই, তা কিন্তু নয়, এদের কারণে অকারণে পুরুষের অকথ্য অত্যাচারও সহ্য করতে হয়। আমাদের দেশে ব্যক্তিগত আইন বলবৎ  থাকায়, সবচেয়ে বেশি মুসলিম মহিলারা পরাধীন। ইসলাম ধর্মে মেয়েদের বেশকিছু ক্ষেত্রে  স্বাধীনতা দেওয়া হলেও, সবকিছু নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পুরুষকে। তাই তারা পুরুষের  নির্দেশ মেনে চলে ধর্মের ভয়ে। এরা দেশের সংবিধান  মানেনা। মানে মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের ফতোয়া। 
      নারী স্বাধীনতা মানে হল, তার আধিকার সম্বন্ধে সচেতন থাকা। সেইসঙ্গে নিজের দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন থাকা এবং তা পালন করা। সে দায়িত্ব শুধু পারিবারিক নয়, সামাজিকও। তবে এই স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। স্বাধীনতা ও স।স্বেচ্ছাচারিতার  সীমারেখা নিজেকেই ঠিক করতে হবে। এর অনেকটাই নির্ভর করে পরিবার, পরিস্থিতি ও মানসিক দৃঢ়তার ওপর।তবে এই ২১ শতকে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার ক্ষেত্রে লিঙ্গভেদে নারী পুরুষের বহু ক্ষেত্রে অধিকারগত পার্থক্য প্রকট ভাবে প্রকাশ পায়। যা উন্নয়নশীল দেশে কোনও ভাবেই কাম্য নয়।
 
                          
লেখকের অন্যান্য লেখা

একক কবিতা সন্ধ্যা



সহজ কবিতা সহজ নয় কঠিনও নয়



মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...