logo corona

সাঁকোটি রহিল ।। সুকান্ত সিংহ
 
 
এই প্রাচীন প্রবাদটির কাছে আমি বারবার ফিরে আসি -- 'পৃথিবীর শেষ গাছটি কাটা হয়ে গেলে, পৃথিবীর শেষ জলাশয়টি বিষাক্ত হয়ে গেলে, পৃথিবীর শেষ মাছটির মৃত্যু হলে আমরা বুঝতে পারব টাকা খাওয়া যায় না।'
খুব সহজ ছিল না হোমোসোপিয়েন্স হিসেবে বেঁচে থাকার যাত্রা শুরু করা। পদে পদে ঠোক্কর, প্রতিটি ঠোক্করকে নতুন কিছু শেখার ব্ল্যাকবোর্ড হিসেবে গ্রহণ করা। সহজ ছিল না বীজ চিনতে পারা। তাকে ছড়িয়ে ঊনকে দুনো করা। সহজ ছিল না ঘর বাঁধতে পারা। আগুনকে বশে আনতে পারা। সহজ ছিল না কৌমজীবনকে এক সূত্রে গাঁথার চেষ্টা করা। তবু মানুষ পেরেছে। স্থান, কালে সেই পারা ভিন্ন হলেও, পেরেছে। ঠিক যেমনটি জন্মে ছিল, প্রবৃত্তি আর জৈবিক ফিতের মাপ মতো ঠিক তেমনটিই আমৃত্যু না থাকতে চাওয়াই মানুষকে অন্যদের থেকে পৃথক করেছে। গ্রহণ আর বর্জনের মধ্যেও সে এনেছে বিবেচনার কোষ্ঠিপাথর। পরখ করেছে, প্রশ্ন করেছে, তুল্যমূল্য বিচার করেছে, এবং এসব একবার করেই থেমে থাকেনি, যতবার ব্যর্থ হয়েছে, ততবারই আবার নতুন করে শুরু করেছে সবকিছু। এই সবকিছু করতে করতে তার ক্লান্তি এসেছে। কিন্তু থামেনি। তাই সে শুধু ঘর বেঁধেই থেমে থাকে নি, আঙিনায় আলপনাও দিয়েছে। জ্বালানো আগুন নিভিয়ে দিতে পেরেছে। যা শিখেছে, তা অন্যকেও শিখিয়েছে। নিজের মুখের গ্রাস তুলে দিয়েছে অন্যকে। একে শুধু  সভ্যতা বলে সংকুচিত করা যাবে না, এই তার উত্তরণ। এই তার গন্তব্যও বটে।
কিন্তু তারপর? হ্যাঁ, তারপর যেদিন থেকে উৎপন্ন ফসলের ভাগ নিয়ে শুরু হল ক্ষমতার ব্যবহার, সেদিন থেকেই সে নিজেকে সঁপে দিল এক অন্ধকার দখলদারির খাদে। সম্ভবত, ইভের আপেলও এতদূর যেতে পারে নি!
অন্ধকার অনেক রকম হয়। শুধু সূর্য ডুবে গেলেই অন্ধকার নেমে আসে, এমনটা নয়। ঘরের বাতি নিভে গেলেই অন্ধকার নেমে আসে, এমনটা নয়। মধ্যদুপুরে কিংবা হাজার ঝাড়বাতির আলোতেও অন্ধকার থাকে। সেটা মনের অন্ধকার। চেতনার ঘুমই অন্ধকার। তখন হাজার সূর্যের আলোও কিচ্ছু করতে পারে না। প্রশ্ন একটাই, এই অন্ধকারকে আমরা কতক্ষণ জাগিয়ে রাখব!
নবনীতা দেব সেন লিখেছিলেন--
'কাছে থাকো। ভয় করছে। মনে হচ্ছে
এ মুহূর্ত বুঝি সত্য নয়। ছুঁয়ে থাকো।'
কে জানত, সেই ছুঁয়ে থাকাই আজ ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে! বন্যার দেশের লোক, অনেকবার বন্যার জন্য বিচ্ছিন্ন হয়েছি বাকী সংসারের থেকে। তবু জানতুম দশ দিন কী পনেরো দিন পর জল সরে যাবে। আবার দেখা হবে, দেখা হবে ব্রাহ্মণবসানে, দেখা হবে সুরতপুরে, দেখা হবে শীলাবতীর ধারে, দেখা হলেই পরস্পরকে জড়িয়ে ধরব। আজ দেখা হওয়া আর জড়িয়ে ধরার মাঝে প্রাচীর তৈরি হয়ে গেল দুদিক থেকেই। অদৃশ্য, কিন্তু অবশ্যম্ভাবী প্রাচীর। সে প্রাচীর ভাঙতে সময় লাগবে। সেটা দুদিক থেকেই।
এর আগেও আমাদের পৃথিবীতে মহামারী এসেছে। আমাদের দেশেই মারীবসন্তে, কলেরায়, দুর্ভিক্ষে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়েছে। সেইসব বিগত মহামারীও তুচ্ছ করার মতো ছিল না। ভয়ঙ্কর আর আরো ভয়ঙ্করের মধ্যে মূলগত তফাত কিছুই নেই। দুটোই আদপে ভয়ঙ্কর। এবং দুটোই পরিস্থিতি। হয় আপাত, নয় চিরস্থায়ী! যদি চিরস্থায়ী হয়! এই যে নতুন এক মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ ভাইরাস, যদি রয়ে যায়? ইতিহাস বলছে মানুষের মধ্যে একটা স্বাভাবিক প্রতিরোধ করার প্রবণতা যুগে যুগেই দেখা গেছে। নিরন্তর প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সে যেমন হারিয়েছে অনেক কিছুই, আবার নতুন করে বেঁচেও উঠেছে। পেয়েছে নতুন পথ। এইটুকুই আমার, আমাদের বিশ্বাসের পুঁজি। বলা যেতে পারে এইটুকুই আসলে পুঁজি। শেষতক।
প্রচলিত জীবনযাপনের দিকে যদি একটু ফিরে তাকাই, কী দেখব? বিগত বেশকিছু কাল ধরে আমরা কি সত্যিই সেই যাপনের মধ্যে দিয়ে গেছি, যেখানে প্রকৃতির বাকী অস্তিত্বকে রেয়াত করেছি বিন্দুমাত্র? জবাবটা-- 'না'। সাধ ও সাধ্যের মধ্যে, প্রয়োজন আর ব্যবহারের মধ্যে ক্রমাগত ফারাক বাড়িয়েই চলেছি। বাকী পৃথিবীর কথা ছেড়েই দিলাম, ভারতবর্ষ, যেখানে উচ্চারিত হয়েছে -- 
"ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরং,
তগস্থি মাংসং প্রলযঞ্চ যাতু,
অপ্রাপ্য বোধিং বহুকপ্প দুর্লভাং,
নৈবাসনাৎ কায়মতশ্চলিষ্যতে।"
কথাটা শুধুই কোনো ধর্মের নয়। শুধুই কোনো অতীন্দ্রিয়কে খোঁজার নয়। কথাটা প্রতিজ্ঞার। কথাটা নিজের কাছে নিজের দায়বদ্ধতার। সেইখানে আমরা কোথায় কোথায় নির্লজ্জের মতো বিচ্যুত হলুম, তা ভেবে দেখার দিন এসে গেল। কোভিড-১৯ কি শুধুই একটি ভয়ঙ্কর ভাইরাস? না, একটি আয়নাও বটে। যেটা আমাদের সবার সামনে ধরা হচ্ছে। নিজেদের স্বভাবের স্বরূপ যদি আজো দেখে নিতে না পারি, তাহলে এহ বাহ্য। যে-যাপনের গোড়ায় ছিল বাহুল্য বর্জন, ছিল অন্যকেও হাত ধরে নিয়ে চলার কথা, সে-যাপনে দখল নিল আত্মকেন্দ্রিকতা। দখল নিল ভোগের আতিশয্য। দেখনদারির প্রতিযোগিতা। একদিনে এসব হয় নি। ধীরে ধীরে হয়েছে। বিজ্ঞানকে শুধুই যন্ত্রসভ্যতা হিসেবে নিয়েছি। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পাওয়াকে মনে করেছি ন্যায্য প্রাপ্য। ক্রমে ঘুণ লেগেছে ভেতরে। এসব নিয়ে প্রশ্ন করতেই ভুলে গেছি! অথচ একদিন আমরাই জানতে চেয়েছিলুম-- 'নাসদাসীন্নো সদাসীত্তদানীং নাসীদ্রজো নো ব্যোমা পরো যৎ। কিম্ আবরীবঃ কুহ কস্য শর্মন্নম্ভঃ কিমাসীদ্গহনং গভীরম্।।'  এবং একদিন আমরাই উচ্চারণ করেছিলুম--  'সং গচ্ছধ্বং সং বদধ্বং সং বো মনাংসি জানতাম্। দেবা ভাগং যথা পূর্বে সঞ্জানানা উপাসতে।।' হ্যাঁ, আমরাই জানতে চেয়েছিলুম যখন আলো ছিল না, অন্ধকারও ছিল না, তখনও কী ছিল! আমরাই একদিন বলেছিলুম আমাদের সবকিছুই হোক একসাথে!
তাহলে তো আমাদের হেরে যাবার কোনো উপায়ই নেই! আজ যদি সব আশা ছেড়ে শুধুই হা-হুতাশ করি, তাহলে সেই যে একদিন, যখন পৃথিবীর আর কেউ নয়, আমাদেরই কোনো পূর্বপুরুষ সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন, তিনিও যে হেরে যাবেন! আমরা তো আগেও এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি, শুধুই অদেখা অজানা জীবাণুর সামনে নয়, বিধ্বংসী বন্যা, ভূমিকম্পের সামনে।  তাহলে! লোভ আর দখলদারির যুদ্ধের বিরুদ্ধে তো আমরাই দাঁড়িয়েছি। তাহলে!
প্রকৃতি পরম। এটা আমাদের মানার উপর নির্ভর করে না, বরং আমাদের জানার উপর আমাদেরই অস্তিত্ব নির্ভর করে। শুধু আলোটুকু আসতে দেওয়া চাই। চেতনার উপর। যে-চেতনা চাইবে-- 'সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ। সর্বে ভদ্রাণি পশ্যন্তু মা কশ্চিৎ দুঃখভাগভবেৎ।' সে চেতনা কীভাবে জেগে থাকবে?
শেষ শয্যায় তথাগত বুদ্ধ। আনন্দ জিজ্ঞেস করলেন-- জ্ঞানসূর্য অস্তমিত, আমরা কার কাছে এবার আলো পাবো? তথাগত বলেছিলেন-- আত্মদীপ ভবঃ। নিজের ভেতরের আলো জ্বেলে দাও।
কঠিন কাজ। পথও দুর্গম। তবু আমাদের পারতেই হবে। আমরা পারবই। এই পারব ভাবাটুকুই আমাদের অস্তিত্ব। আমাদের চিরকালের পাথেয়।

একক কবিতা সন্ধ্যা



মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...