একক কবিতা সন্ধ্যা ।। মনোতোষ আচার্য

monotosh1

মনোতোষ আচার্য-র এক গুচ্ছ কবিতা

 

 

 

কষ্ট পাই গোপন প্রহরে 

সরল উপপাদ্যের মতো গাণিতিক জীবন জ্যামিতি
কান ধরে ওঠায় বসায় মিথ্যের ভরাগাঙে
তেমন কিছুর মতো তোমাকে ভাবিনি বলে কষ্ট পাই গোপন প্রহরে

অনেক জানার মাঝে অজানারা লুকিয়ে রেখেছে ডালপালা
সেইসব পুরোনো সম্পর্ক ভাঙা রোদ্দুরের চিলেকোঠা থেকে
ডাক আসে অনন্তের ডাক...
আমাকে বিষাদ মেঘ ভিজিয়ে ভাসায়...

বিশ্বাসের ডিঙিখানি টলোমলো আরক্তিম হাওয়া
আমি তো বন্ধুর খোঁজে কাটিয়েছি আসমুদ্র টিলা
সভ্য মানুষ যাকে বানিয়েছে পিকনিক স্পট

তোমার হৃদয়ে বাজে গাজনের মন্দাক্রান্তা মেঘ
তবুতো আঙুর খেতে নেমে আসা অকাল প্লাবন
বিশ্বাসের বনকথা পাশ ফেরে অস্তিত্বের গান
অন্ধ তমাল গাছে কীর্তনের বিনম্র আজান

অজানা জ্বরের কাছে রেখে যাওয়া মেঘলা নূপুর
কবিতা এঁকেছে গ্রাম অভিমানী সারাটা দুপুর...

 

ধ্বনিমালা

আপন দুঃখের কাছে বারবার ফিরে আসে হাওয়া
আপন সুখের কাছে প্রিয়তম প্রতারক ঘোর
করতলে সাদৃশ্যশৃঙখল...

শরীরে বাঁশির ডাক দুঃখমোচী স্মৃতিরোদ্দুর
ঠাহর হয়নি বলে শব্দচিত্র বৈচিত্র্যময়
ভজনীয় মেঘশ্যাম বৃক্ষজন্ম জীর্ণবসত
মাটিতে স্নেহজ মুদ্রা
পাতাখসা পাখির আশ্রয় গুঁড়ো গুঁড়ো জ্যোৎস্নাবিন্দু...

গভীর রাতের গাঙে ঢেউভাঙা মাছেরা স্বাধীন
মেতে ওঠা পলাশের বনে অতৃপ্ত তমাল ছায়া
নীরবে ভাবায় অভিমান ফসলের মাঠজুড়ে অস্তিত্বের গান।

হলুদবাড়ির মায়া বিবক্ষাপ্রাচীন পরিমিতি পাঁজরের টান
শব্দগামী ইচ্ছেগুলো প্রতিরোধী পাঠক্রমে আর্ত আহ্বান ...

 

অস্পষ্ট আলোর কাছে

'উতো তস্মৈ তন্বং বিসস্রে জায়েব পত্য উশতী সুবাসাঃ'----ঋগ্বেদ
(সুন্দর বস্ত্র ও অলংকারে সজ্জিত স্ত্রীলোক যেমন স্বামীর সামনে নিজ স্বরূপ প্রকাশ করে তেমনই শব্দ,অর্থ হৃদয়ঙ্গমকারী বিদ্বানের নিকট বিদ্যা স্বীয় স্বরূপ প্রকাশ করে।)

দুরন্ত ডানার নীচে ভাবনার ভস্ম মাখা সমূহ জীবন
পতিত সন্ধ্যার গানে উগ্রপন্থী আবাল্য প্রণয়
অন্ধকার লুকোনোর উপত্যকায় দশক বদলের স্বপ্ন
হামাগুড়ি দিয়ে আসে দ্বান্দ্বিক জগৎ ...

ভেতরের কথাগুলো সৌজন্য শেখেনি
তাই তো জলের কাছে অপার বিস্ময়
পটের তুলির টানে প্রাচীন কাহিনি অসীমের গল্প খোঁজে
দু'একটি স্পন্দন আজ লেখা আছে কালের খাতায়

তোমাকে সকাল ভেবে ফোন করি বিকেলের গাঙে
সূর্যাস্ত মেখেছি আজ সারা গায়ে দ্রুতগামী আলোর প্রহর
নিসর্গের শব্দমালা ছুঁতে চায় আঁধারের কারু
নগরকীর্তনে ছায়া মেলে ধরে রহস্যপ্রাচীন দেবদারু...

 

পুরোনো আশ্রয় ছেড়ে

অনন্ত প্রবহমান গাথাগুলি ঢেউ তুলছে স্মৃতি রোদ্দুরে
স্তনভাঁজে রূপকথা হারানো নগর
রূপজীবী গুল্মলতা প্রনোদিত প্রজনন মায়া
ধুলোট স্বপ্নের ঘায়ে ভেঙে গেছে বাসরের ব্রত


এত প্রবঞ্চনা ঘোর, এত মৌন শিরালি আবেশ
কোথায় লুকোবো 'আমি' কীটদংশ কালের প্রহার
ফুরিয়ে গিয়েছে পুঁজি জেগে আছে কাঁকড়াবিছে পথ
রণসাজে মেতে ওঠে মৃত্যুচেতা মহাভৈরব

পুরোনো আশ্রয় ছেড়ে গেয়ে উঠি বজ্রের গান
এখনো চোখের খাঁজে ধ্বনিময় ঋত মহাযান।

 

ইন্দ্রিয়ের অসীম জলে

গৃহবন্দী সকাল গুমরে আছে। সারাপাড়া শরীরের বাধা
পত্রাবলীর পৃষ্ঠা ওল্টাতে ওল্টাতে পড়ে ফেললে
হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে লেখা কয়েকটা চিঠি
বিবেকানন্দ যাঁকে দেওয়ানজী সাহেব বলে ডাকতেন।


আঠারো'শ বিরানব্বই এর ঋতুবৈচিত্র্য খুঁজতে খুঁজতে ফিরে এসেছো
মনীন্দ্র গুপ্তের কবিতার অতল দিঘির ঘাটে
সাংসারিক অন্যমনস্কতা বারবার বিঘ্ন ঘটাচ্ছে ডুবে যাওয়াতে

ডুবতে চাইছো ইন্দ্রিয়ের অসীম জলে
অথই কামনার লবণাক্ত স্রোতে মসৃণ স্তব্ধতায়...

 

গল্প

পুরোনো ভিখিরিরা আজ আর আসে না দুয়ারে
বৈশাখের খর রৌদ্রে লাউতম্বা বাজিয়ে কাকদ্বীপের ইস্টিমার
পেটুয়াঘাটের কাছে ফেরি করে যেত
নৌকাডুবির গল্প
মা,খুড়িদের সাথে আমরা কেঁদে উঠতাম
বেতের কুঁচো ভরতি চাল আর বাগানের ফল- সবজি দিয়ে
'আবার আসবেন' বলে বিদায় জানাতাম,
এখন ভিখিরি আসে ফিলমি গানের ঢঙে কথা কয়
নোট চায়, ভোট চায়
আরও কিছু চায়
ইড়া ও পিঙ্গলা ছুঁয়ে আরক্তিম হয়ে উঠি ভ্রূ-মধ্যরেখায়।

 

কুটুম মেয়েটি একা

ভালোবাসা বাঁধিয়েছি শক্ত মলাটে, কিছুতে ছেঁড়ে না পাতা
এ 'আমি'র নরম আদর, মায়াবী আকাশ গলে যায়
গ্রীষ্মে আমের বনে খালি পায়ে নকল মহড়া
সেজেছি সম্রাট
তরবারি ধরবার কৌশল শিখিনি বলে কতবার যুদ্ধে হেরেছি
সে বাহুবলের কাছে মিথ্যে হয় সাম্রাজ্যবিস্তার, রণনীতি...

স্কুলছুট দুপুরের বাদাড় পেরিয়ে আমরা এসেছি এক
রহস্য নদীর মিঠা স্রোতে যেখানে প্রাচীন মাছ
জীবনের সংলাপ জলে শ্বাস নেয়, চারাপোনা খেলিয়ে বেড়ায়
বঁড়শি জানে না তার স্বাভাবিক জীবন যাপন,
প্রতিশোধ তার তাই জানা হয় নাই।

গাছে গাছে কুল পেতে উঠবার আগে আমাদের শিস্তিতে
ছুটে যেত গ্যাংটা পাথর। বুভুক্ষু উদর তার পেয়েছিল স্বাদ
পৃথিবী নিশ্চয় জানে আরো জানে লতাপাতা, পুঁইমাদা, ঝিঙেমাচা
গোধূলির কুঁড়াজালি, রোগা চিংড়িরা...
পুদিনাপাতার গন্ধে জাদুওড়নার রঙ দেখে লুকিয়েছিল
পাকা উচ্ছে, কুমড়োর ফুল --- কুটুম মেয়েটি একা
জোনাকি পাহারা ...

 

ভূমিস্পর্শমুদ্রা

মনে করো খেয়ালি নূপুর বেজেছিল আর্দ্র বাতাসে
আলো ডোবা পরকীয়া মাস লুকোচুরি তোমার উঠোনে
মনে করো স্কুল ফেরা হাঁটা পায়ে পায়ে আদর জড়ানো

বিকেলের চায়ের দোকান, মোড়ের মাথার মিষ্টিঘর
ভাটিয়ালি সুরের জাদুতে জেগে আছে সুবিশাল চর
আঙুলে আঙুলে ছায়া ঋণ অন্তহীন সম্বিৎ সাগর

পরজন্মে ফুটে উঠি মৃত্যুজয়ী বাগানের ফুলে
বৃষ্টি উৎসব যেন মঙ্গলসূত্রে আঁকা স্মৃতি
কাটতে চায় না আজো ঘোর…এ জীবন মায়াবী বিস্ময়।

 

মায়ামৃগ

স্বপ্নস্বরূপিনী দেশ বুনে দিচ্ছে শিরায় শিরায় লাস্য অভিসার
মুক্তক ছন্দের মতো তটিনী প্রবাহ আর ধুলোট মানুষ
অলৌকিক জাদুকাঠি ইচ্ছে পূরণের স্বপ্নে ভাষণ বিলাস
পুরোনো গানের সুরে আলপথ, ভাঙামঠ কিছু চেনা যায়

প্রবচনে সুরক্ষিত স্তবগান, পুষ্পবৃষ্টি, চারিত্রিক লিপি
রৌদ্ররসে কীর্তি গাথা দগ্ধ দিন, পরিযায়ী রাতের জঠর
দৃশ্য থেকে দৃশ্যপট জন্ম পরম্পরা মাগধী অপভ্রংশে তোমার লিখন।

বিকেলের রামধনু সাঁঝের জোনাকি… প্রজ্ঞা ও নীরবতা মানসিক স্থিতি
বিরোধী ঝাণ্ডায় ওড়া বুভুক্ষু পাঁচালি
এসো তবে মায়ামৃগ আলোক ইশারা খুঁজে মরি!

 

ভাস্কর্য

ভাঙা প্রতিশ্রুতি ও কানা অবজ্ঞার হাওয়ায়
ভেসে চলা ছেঁড়া ঠোঙাটির মতো জীবন যাপন

চোখের আড়ালে থাকে ঢঙ্… সুখ স্বপ্নে চোখ বুজে
নতুন ভাস্কর্য খুঁজে দেবী প্রতিমায়
আগুনপাখির গল্প আর তোলপাড় করে আনি সারাটা পৃথিবী।

শীতার্ত সরীসৃপ হাই তোলে শিকড় বাকড়ে, স্পর্শ করি প্রাগার্য নির্মাণ
আত্মখনন শেষে চেয়ে দেখি রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে
আদিভূতার থানে মানতের ঘোড়াগুলি।

মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...