বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : আমাদের শিরদাঁড়া
 
birendra chattapadhyay

এক বিপন্ন দৃশ্য দেখিয়ে ছিলেন এক বন্ধু। যুদ্ধ-পীড়িত একটি কিশোরীর কাছে সাংবাদিক জানতে চাইছে -- সকালে সে কিছু খেয়েছে কি? দুপুরে? সেই কিশোরী দুটি প্রশ্নের উত্তরে মৃদু ঘাড় নেড়ে 'না' বলতে বলতেই একবার ম্লান হেসে দু'হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে ফেলতে চাইল। ঢেকে ফেলতে চাইল অসহায় খিদের কথা এভাবে বলতে হল বলে। খিদে শুধু নয়, এক সংকোচ যেন সে আড়ালে রাখতে চাইল!

সেই সন্ধ্যায়, যেখানে আমরা ছিলুম, অনেক আলো ঝলমল করছিল, সেই সেই সন্ধ্যায়, সেই ঝলমলে আলো জ্বলে ওঠা উৎসবমুখর সন্ধ্যায় কে যেন আমার কানে তপ্ত সীসার মতো এই পঙক্তিগুলি ঢেলে দিতে দিতে বলে গেল–

‘আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির আকাশে
কারা যেন আজও ভাত রাঁধে
ভাত বাড়ে, ভাত খায়
আর আমরা সারারাত জেগে থাকি
আশ্চর্য ভাতের গন্ধে
প্রার্থনায়, সারারাত।’
                 -- (আশ্চর্য ভাতের গন্ধ)


প্রায় ১০০ কোটি মানুষ এই পৃথিবীতে আজও অভুক্ত থাকে। আমার এই দেশে প্রায় কুড়ি কোটি মানুষ কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়ে রাতের অন্ধকারে। না। শুধুই শস্যের অপ্রতুলতা এর কারণ নয়। মাঠ থেকে খামার, খামার থেকে গোলায় উঠে আসার যে চিরন্তন পরিক্রমা শস্যের, তার মাঝে বসে থাকে ক্ষমতার নখ। সে নখের দাপটে তৈরি হয় নিরন্ন মুখ। আর আমরা যারা, সেই শিকারীর নখ থেকে কোনোভাবে একটু দূরে সরে গেছি, তারা সারারাত প্রার্থনায় থাকি। ভাতের প্রার্থনায়। সে প্রার্থনায় চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ভাত ফুটে ওঠার গন্ধ। সেই কিশোরীর মতো।

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। হ্যাঁ, তিনিই সেই কবি যিনি আজীবন কবিতাকে কল্পনার অক্ষয়কীর্তির থেকে বার করে এনে একেবারে রোজকার জীবনের ক্ষয়, ক্রোধ, তেজ, অসুখ আর খিদের কাছে দাঁড় করিয়েছিলেন। শব্দের সমস্ত মুখ নিয়ে বসেছিলেন বাঁচার দিকে। বেঁচে ওঠার দিকে। প্রতিরোধ, তা সে যতই ভঙ্গুর হোক না কেন, প্রতিবাদ, তা সে যতই ক্ষীণ হোক না কেন, যতই নিভু নিভু হোক না কেন, তাকে যতটা সম্ভব জাগিয়ে রাখাই ছিল তাঁর সারা জীবনের ব্রত। এই ব্রত থেকে একপলকের জন্য সরে আসেননি তিনি। এইখানেই তিনি কবি। সম্পূর্ণ কবি। যিনি আজীবন বিশ্বাস করেছেন কবির কাজ প্রশ্ন করা। জীবনকে, যাপনকে, এবং পারিপার্শ্বিককে।

খিদে। এই চরম সত্যের কাছে পাঠক, আমরা একটু থাকি। হ্যাঁ, খিদে চিরন্তন সত্য। যে সত্য সিদ্ধার্থ বুদ্ধ হবার সময় উপলব্ধি করেছিলেন, সেই সত্য আজও সর্বকালের সর্বদেশের চিরন্তন সত্য। তিনি সুজাতার হাত থেকে পায়েস গ্রহণ করে পুনরায় ইহাসনে বসেছিলেন। খিদে সবকালের প্রধান মাতৃভাষা। এর অধিক বা নূন্য বলে কিচ্ছু হয় না। শুধু কালে কালে তাকে নিয়ে লোফালুফি করা হয়েছে। যার বলি হয়েছে, হয়ে চলেছে মানুষ। আজও এর হাহাকার কান পাতলেই শোনা যায়। সেখানে একটি দেবতা, অন্ন। ‘অন্ন মিতি হোবাচ সর্বানি হবা ইমানি ভূতাম্নমেব’–ছান্দোগ্যোপনিষদের এই শ্লোক সূচনায় রেখে বীরেন্দ্র লিখলেন–

'অন্ন বাক্য অন্ন প্রাণ অন্নই চেতনা;
অন্ন ধ্বনি অন্ন মন্ত্র অন্ন আরাধনা।
অন্ন চিন্তা অন্ন গান অন্নই কবিতা,
অন্ন অগ্নি বায়ু জল নক্ষত্র সবিতা।।
অন্ন আলো অন্ন জ্যোতি সর্বধর্ম সার
অন্ন আদি অন্য অন্ত অন্য অন্নই ওঙ্কার।
সে অন্ন যে বিষ দেয় কিংবা তাকে কাড়ে
ধ্বংস করো, ধ্বংস করো, ধ্বংস করো তারে।।’
                        --(অন্নদেবতা)

আজো এই পঙক্তিগুলিকে অস্বীকার করবার কোনো কারণ আমাদের সামনে এসেছে কি? এই যে শেষ দুটি পঙক্তিতে তিনি ডাক দিলেন, এ তো কোনো নির্দিষ্ট সময়ের ডাক নয়। খিদে আর লুণ্ঠনের মধ্যে যে অনিবার্য সংঘাত লুকিয়ে থাকে চিরকাল, এ তো তার এক শঙ্খনিনাদ‌। দখলের প্রবণতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সমবেত গান। অস্তিত্বের মধ্যিখানে থাকা সারস্বতের মন্ত্র।

এই তীব্রতা, এই গভীরতাই বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার ধ্যানবিন্দু। তিনি কখনো এই বিন্দু থেকে বিচ্যুত হন নি। সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধি করেছেন চারপাশকে। খুব কাছের থেকে দেখেছেন দৈনন্দিন জীবনকে। দেখেছেন বলেই, উপলব্ধি করেছেন বলেই এমন সপাট উচ্চারণ হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতা–

‘মুখে যদি রক্ত ওঠে
সে-কথা এখন বলা পাপ।
এখন চারদিকে শত্রু, মন্ত্রীদের চোখে ঘুম নেই,
এ-সময়ে রক্ত বমি করা পাপ; যন্ত্রণায় ধনুকের মতো
বেঁকে যাওয়া পাপ; নিজের বুকের রক্তে স্থির হয়ে শুয়ে থাকা পাপ। ’
           -- (মুখে যদি রক্ত ওঠে)

এ কবিতার শরীরে কোথাও এতটুকু স্থূলতা নেই। কথার অতিরিক্ত ফেনিয়ে বলা নেই। সে চেষ্টাও নেই। নেই বাহুল্যের আতিশয্য। এক নির্মেদ কথন। যা ধরে রাখে অনেক উচ্চারিত ও একই সাথে অনুচ্চারিত বেদনার ছাপ। যা স্বীকারের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদের, চোখে আঙুল দিয়ে পরিস্থিতির নির্ভুল চিত্র ধরে তোলে আমাদের সামনে। মিতকথনে এমন রক্তক্ষরণের জীবন্ত দৃশ্য দেখাতে তিনিই সক্ষম ছিলেন। এটা আমরা খুব মন দিয়ে যদি তাঁর কবিতা পাঠ করি, তাহলেই বুঝতে পারব। যেমন এই কবিতাটি–

'কে মুখোশ, কে মুখ এখন
স্বচ্ছ কিছু দেখা যায় না। কঠিন অসুখ
সেরে গেলে যেরকম অসহায়;
মাথার ভিতর শুধু স্মৃতি ঘোরে, শিয়রে, পায়ের কাছে
ইচ্ছেগুলি সাপের চুমার মতো অন্ধকার, আর ঘুমের ভিতর স্বপ্নগুলি
পারে না নিঃশ্বাস নিতে। '
             -- (কে মুখোশ,কে মুখ, এখন)

এই যে 'এখন' শব্দটি। পাঠক, কবিতাটি লেখা হয়েছিল ৩ জুলাই হাজার ১৯৬৮ সালে। সেই কত বছর আগে লিখে রাখা 'এখন' সে তো আজো 'এখন'। যে 'এখন' ঠিক আজো মুখ আর মুখোশের কণ্ঠে ভেদ খুঁজে চলেছে। কয়েক শতাব্দী আগে, কয়েক শতাব্দী পরেও।


চল্লিশের দশকে শুরু হলেও বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে স্বরূপে আমরা পাই পঞ্চাশের দশক থেকে। তারপর থেকে যতদিন তিনি লিখেছেন, তাঁর লেখা হয়ে উঠেছে দেশ ও মানুষের দর্পণ। বলতে দ্বিধা নেই সে দর্পণে যেটুকু ধুলো পড়েছে, তা আমাদের দোষে। আমরা হঠাৎ করে ভাবতে শুরু করলুম তিনি কোনো নির্দিষ্ট একটি গণ্ডির কবি। এটা তাঁর নয়, আমাদের ক্ষতি। মানবতা ছাড়া তাঁর কোনো দ্বিতীয় মত ছিল না কোনো কালেই। তিনি তাঁর সমস্ত কবিজীবনে এই মানবতার পক্ষেই কথা বলে গেছেন। এর সুর হল কল্যাণের সুর। যা কালরহিত। খুব কাছ থেকে দেখেছেন দেশ, সমাজের ভাঙনকাল। যে ভাঙন এসেছে কখনো বিশ্বযুদ্ধ রূপে, কখনো মন্বন্তর হয়ে, কখনো বা দেশভাগের রূপে।

এতো এতো ভাঙনের দৃশ্যে তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন স্খলন, প্রত্যক্ষ করেছিলেন মনুষ্যত্বের চরম অপমান। এখান থেকে তিনি আগুনে পোড়া শব্দ নিয়ে ভরিয়েছেন সাদা পৃষ্ঠা। আর সেই জন্যই তাঁর কবিতা থেকে এখনো, আজও উত্তাপ বেরিয়ে আসে। ছ্যাঁকা দেয় আমাদের। খুলে দেয় ভালো থাকার ভান-কে।

সে ভান তিনি ধরে ফেলেন--

রাজা আসে যায়     রাজা বদলায়
নীল জামা গায়       লাল জামা গায়
এই রাজা আসে      ওই রাজা যায়
জামা কাপড়ের       রং বদলায়...
                              দিন বদলায় না!
গোটা পৃথিবীকে গিলে খেতে চায় সেই ল্যাংটো ছেলেটা
কুকুরের সাথে ভাত নিয়ে তার লড়াই চলছে, চলবে!
পেটের ভিতর যে আগুন জ্বলছে এখনও জ্বলবে।'   
           -- (রাজা আসে যায়-১)

শুধু লেখা নয়, সময়কে ধাক্কা দেওয়াও একজন কবির কাজ। এটা কোনো বিশেষ ঝোঁকের ব্যাপার নয়। ঝাঁকের ব্যাপার তো নয়-ই। এ হল এক দায়িত্ববোধ। একজন কবি, তাঁর চৈতন্যে যদি কোথাও সমাজ নামক শব্দটি এসে থাকে, তিনি এর থেকে সরে দাঁড়ান না। বীরেন্দ্র ধাক্কা দেন–

‘দীর্ঘ দেবদারু বীথি কোন আকাশ দেখে না
এখন আকাশ জুড়ে নষ্ট চাঁদ, শুরু হবে পিশাচের নাচ;
এখন বাতাস দগ্ধ দুধকলা দিয়ে পোষা সাপের নিঃশ্বাসে...
ভাল আছে নিরাপদ– আমাদের মাননীয় মানব সমাজ।’
                        -- (নিরাপদ মানব সমাজ)

এভাবেই তিনি ধাক্কা দেন। কখনো তীব্রভাবে কখনো খুব নম্র ব্যঙ্গের সুরে। এভাবে বলার জন্য খুব জরুরি আপসহীন মনের। কোনো গোপন চুক্তির কাছে বাঁধা থাকলে এমন নম্র, যেন কিছুটা নিচু স্বরে এমন 'নিরাপদ' শব্দটি ব্যবহার করা যায় না। এই ব্যতিক্রমী দীপ্তি শুধু একবার নয়, অনেকবার তাঁর কবিতায় দেখতে পাব–

‘আজও খুনি হেঁটে যায় প্রত্যেকের চোখের সামনে
মায়ের চোখের জল, শিশুর লহুতে ভাষা আমার স্বদেশে।
কেউ নেই তাকে প্রশ্ন করে, কেউ নেই প্রকাশ্য রাস্তায় তার কাঁধে
হাত রেখে বলে– তোমার বিচার হবে। ’

খুব স্পষ্ট করে বলা নয় কি কথাগুলো? এই যে এড়িয়ে যাবার, চুপ করে থাকবার এক অভ্যাস আমরা গড়ে তুলেছি নিজেদের মধ্যে, সে কথা কি এমন স্পষ্ট করে আর কেউ বলেছেন! এবং এরপর যেন আঁখো দেখি ধারাবিবরণী, দেখিয়ে দিলেন আমাদের ভেতরকার ছবি, কবিতার একদম শেষে এসে–

‘সকলেই চিতার আগুন নিভিয়ে কলসির জলে
ঘরে ফেরে, ভোরবেলার কাগজে
দেখবে বলে মৌন-মিছিলের ছবি।’
                 -- (আজও খুনি হেঁটে যায়)

হ্যাঁ, এই হলো বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা। তাঁর উপলব্ধি। না, আমি অন্তত একে অস্বীকার করি না। প্রতিবাদহীন বেষ্টনী দিয়ে নিজেকে ঘিরে রাখি বেঁচেবর্তে থাকার জন্য। বাঁচা– হ্যাঁ, ভনিতাহীন এক সত্য তিনি দেখিয়েছেন, যেন সত্যিই আমরা মৌন-মিছিলের ছবিতে নিজেদের হেঁটে যাওয়া দেখব বলেই প্রকাশ্য রাস্তায় খুনীকে চিনতে পেরেও বলিনি–"তোমার বিচার হবে"।

কারা যেন শুধুই কিছু তীব্র শব্দের বিচ্ছুরণ খুঁজে ছিল তাঁর কবিতায়? কোথায় এখানে ঝলকানো তীব্রতা! অথচ এই পঙক্তিগুলি আজও তাপ ছড়ায়। কেননা–বেঁচে আছে। আপনার সহ্য ক্ষমতা আর একটু চাইছি পাঠক। এইটে পড়ুন একবার–

‘নিঃশ্বাস নিতেও মানা
কেন না মানুষ এই অন্ধকারে নিজের মুখকে
লুকিয়ে রাখার জন্য
চারদিকে কসাইখানার মধ্যে
ছ’ফুট মাটির নিচে চুপচাপ স্থির বসে আছে।
কোথাও জানলা নেই
দরজার কথা ভাবা অসম্ভব,
কেননা বাতাস ঢুকলে কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান
হতে হবে, কেননা ঘরের মধ্যে, ঘরে বাইরে।
অন্তহীন দ্বেষের আগুন। ’
                        -- (এই অন্ধকার)

এই কবিতাটি পড়ার পর কোথাও-না-কোথাও ধরা পড়ে গেলাম। এই যে বলা হল–‘দরজার কথা ভাবা অসম্ভব’, এই অসম্ভব যেন আরও দীর্ঘ হচ্ছে । যেখানে সে নিজে দীর্ঘ হতে পারছে না, সেখানে তার ছায়া দীর্ঘ হচ্ছে। একে স্বীকার করলেও সত্য, অস্বীকার করলেও– সত্য। আর তার জন্য কোনো প্রগতি শিবিরের প্রয়োজন হয় না। শুধু দরকার হয় উপলব্ধির। এখানেই বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর দায়ে কমিটেড। চিরকাল। তাতে তাঁকে কেউ ধ্বজা তুলে দিক বা না দিক, কিছু এসে যায় না।

তিনি তা জানতেন। নিঃসন্দেহে জানতেন। কবিতা কেবলমাত্র পাঠের জন্যই তিনি লেখেননি। এ ছিল তাঁর কাছে এক আয়ুধ। সমস্ত রকম অকল্যাণকে ছিন্ন করবার আয়ুধ। এখানে যদি কোনো পক্ষপাতিত্ব থেকে থাকে, সে পক্ষপাত কল্যাণের দিকে। ক্ষুদ্রের নয়, সমগ্রের দিকে। এই জন্যই তিনি যখন লেখেন–‘মানুষ রে, তুই সমস্ত রাত জেগে / নতুন করে পড়,/
জন্মভূমির বর্ণপরিচয়।’–তখন তা আর  শুধু কোনো নির্দিষ্ট দেশের কথায় আটকে থাকে না। দেশের মাটি, তার মানুষকে চেনার জন্য জন্মভূমির প্রকৃত বর্ণপরিচয় জানা সব দেশের মানুষের জন্যই জরুরি। পৃথিবীর সব দেশের জন্যই। কেননা এর সাথে জড়িয়ে আছে মানবের অস্তিত্বের প্রশ্ন। যে অস্তিত্বে সবসময় জড়িয়ে থাকে দেশ-কাল।

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সচেতন কবি। সমাজ সচেতন কবি। মধ্যস্বত্বভোগী কবি নন। ঠিক এই কারণে বলতে পেরেছিলেন–

'গানের পাখিদের
খাঁচায় পুরে,
তাদের হুকুম করা হচ্ছে
‘বলো হে, যুগ যুগ জিও–’
হয়তো একদিন
আকাশের সূর্যকেও
তাঁরা হুকুম করবেন
‘শোন হে, কান ধরে নীলডাউন হ’য়ে থাকো।'
                          -- (সূর্য কেন বাদ যায়)

বলতে পারেন–

‘মানুষখেকো বাঘেরা বড় লাফায়
হেঁড়ে গলায় ঘর দুয়ার কাঁপায়।
যখন তারা হাঁক পাড়ে, বাপস্ রে!
আকাশ যেন মাথায় ভেঙে পড়ে!
ভয়ের চোটে খোকাখুকুরা হাঁপায়!
মানুষ খেকো বাঘেরা বড় লাফায়...’
             --(মানুষ খেকো বাঘেরা বড় লাফায়)

যে আস্ফালনের তীব্র বিষ ক্রমাগত খাদের দিকে টেনে নিয়ে যায় আমাদের। প্রবলের, প্রতাপের, যে দাপট ক্রমাগত নিঃশেষ করে দিতে চাইছে আমাদের বেঁচে থাকাকে, তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তাঁর কবিতা। হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার শ্বাসবায়ু।

শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন –‘শুধু বেঁচে বর্তে থাকাই তো একজন মানুষের অণ্বিষ্ট নয়। নিজের ছোট, চিলে ঘরটিতে বসে একতারা বাজিয়ে সারাজীবন প্রেম আর অপ্রেমের গান গাওয়া– তাও নয়। মানুষ কোনো ঈশ্বরপ্রেমিক বৃক্ষ নয়, সারাজীবন ধরে তাকে রাস্তার পর রাস্তা হাঁটতে হয়।’

তিনি হেঁটেছেন। এই ছিল তাঁর স্পর্ধা। তাঁর কবিতার স্পর্ধা।


শুধুই কি তীব্র ক্রোধ? শুধুই কি জ্বলে পুড়ে যাওয়া! না। কখনোই নয়। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কখনো একদর্শী ছিলেন না। মানুষের লাঞ্ছনা, অসহায়তা, ছিন্নমূল পরিস্থিতি, বাঁচার তীব্র ব্যাকুলতা তিনি যেমন কোনো বাকচাতুরী ছাড়াই তুলে ধরেছেন কবিতায়, ঠিক একইভাবে তিনি আস্থা রেখেছিলেন মানুষের কাছেই। তাঁর উত্তাপ ও মমত্ববোধ যুগপৎ প্রতিভাসিত হয়েছে।

'মাটি তো আগুনের মতো হবেই
যদি তুমি ফসল ফলাতে না জানো
যদি তুমি বৃষ্টি আনার মন্ত্র ভুলে যাও
তোমার স্বদেশ তাহলে মরুভূমি।
যে মানুষ গান গাইতে জানে না
যখন প্রলয় আসে, সে বোবা ও অন্ধ হয়ে যায়। তুমি মাটির দিকে তাকাও, সে প্রতীক্ষা করছে, তুমি মানুষের হাত ধরে, সে কিছু বলতে চায়।’
                    -- (জন্মভূমি আজ)

একটি গল্পে তিনি লিখেছিলেন একেবারে শেষে এসে– '‘বীরেন। তুই ঠিকই বলেছিলি– মানুষ নষ্ট হয় না। কোনোদিনই একেবারে নষ্ট হয়না। তিন বছরের শিশু, তাকে যত চড় মারো;  তেইশ বছরের যুবককে রাজনীতি ছাড়িয়ে বিয়ে দাও, একটা একশো টাকার চাকরির জন্য তাকে পাগল করে দাও– সব নরক সে পার হয়ে যাবে। কোনো জরুরি আইনের চোখ রাঙানি, কোনো মাস্টার মশাইয়ের ‘স্ট্যান্ড আপ অন দা বেঞ্চ’ তাকে একবারে শেষ করে দিতে পারে না"।
                     -- (নষ্ট হওয়ার গল্প)

এই আস্থা তাঁর ছিল। জরুরী অবস্থার সোচ্চার বিরোধিতা হোক, বন্দীমুক্তি আন্দোলন হোক, সব সময় তিনি আস্থা রেখেছেন প্রবহমান মানবতার দিকে। আগুন ও ঝড়ের পরেও তিনি জানতেন মানুষ মাটি পেলে প্রতিমা গড়বেই। এর জন্য দরকার প্রস্তুত থাকা --

'তোমার কাজ
আগুনকে ভালোবেসে উন্মাদ হয়ে যাওয়া নয়–
আগুনকে ব্যবহার করতে শেখা।
অস্থির হয়ো না;
শুধু প্রস্তুত হও।’
               -- (সাগ্নিক)

তিনি জানতেন মুঠো কখনো খালি রাখতে নেই। ক্ষত আর ক্ষতির মাঝেও তিনি জানতেন এইটি তিনি। 'জেন' কবিতার মতো উচ্চারণে --

‘সারা দুপুর পাখিগুলি
রোদ পোহায়;
সমস্ত রাত পাখিগুলি
শীত তাড়ায়।’
                   -- (পৌষ)      
      
ক্যান্সার ধরা পড়েছে। কেমোথেরাপি চলছে। তখনও তিনি অক্লান্ত। তরুণ কবিদের উদ্দেশে প্রয়াণের চার মাস আগে ৪ এপ্রিল ১৯৮৫ সালে লিখলেন –

‘অনেকদিন শব্দেরা আমাকে ত্যাগ করেছে
অথচ আমি এখনও কিছু বলতে চাই

তরুণ কবিরা। তোমরা এগিয়ে এসো।
পৃথিবীর সব শব্দ ফুরিয়ে যায় নি।
আমি তোমাদের পায়ের শব্দে
          আমার রাস্তা চিনে নেবো। ’
                               -- (তরুণ কবিরা)

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কবিতাকে তিনি কখনো জীবনের উপরে রাখেন নি, জীবনের সঙ্গে রেখে ছিলেন।

একক কবিতা সন্ধ্যা



মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...