মনকেমনের জানলা ।। কেশব মেট্যা

 

বাবা চেয়েছিলেন দোতলার পশ্চিমের ঘরটির উত্তর দিকে কোনও জানলা থাকবে না। থাকবো আমি। ওদিকে ঝোপঝাড় আর সেই পুকুর! তাই বন্ধ থাকবে ওদিক। তার চেয়ে পশ্চিমদিকে দুটো বড় বড় জানলা হয়ে যাক।
আমি মানতে পারলাম না। দক্ষিণ এর জানলা রোমান্টিক, শুনেছি পড়েছি। দক্ষিণেও যদি সমস্যা, তাহলে আমার অন্তত একটা উত্তর থাকুক।
অনেক তর্ক রাগ অভিমানের পর ঠিক হয়ে যায় উত্তর। আমার উত্তুরের জানলা। কে জানতো এই এক উত্তুরের জানলাই আমার জীবনের পরম আশ্চর্য হয়ে উঠবে!

       শিরীষ বড় হয়ে গেল দেখতে দেখতে। তার ডালপালার সংসার থেকে একখানা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে  জানলায়। তোমার হাতে কী দিই বলোতো শিরীষ! আমার তো এই বাউন্ডুলে জীবন। ঘরময় ঝুল, ধুলো, ঘামে ভেজা জামা আর বই। কী বা দিতে পারি! বরং বিকেলের রোদ পড়ে এলে সারাদিনের গল্প শোনাবো তোমায়। কিংবা রেডিওর দু এক কলি রবিঠাকুর। শুনবে তো?

          প্রতিদিন যেভাবে বিকেল আসে দুপুরকে না জানিয়ে, তেমনি এই বিকেলগুলো গোপনে মায়াময় হয়ে উঠলো। নির্জন দুপুরের ডাহুক যেমন ঝুপ করে লুকিয়ে যায় বিকেলের পায়ের শব্দে, তেমনি আমিও আড়াল হয়ে যাই আমাদের মধ্যবিত্ত সংসারের সমস্ত কোলাহল থেকে। এক্কান্নবর্তী পরিবারে নির্জনতার ফুরসত, কম কথা নয়। কথা হয় হাওয়ায় হাওয়ায়। এই যে পাতার নির্ভার প্রাণময় দুলে ওঠা, তা কি এমনি এমনি? এ যে অনুপম নির্জন অভিসার... আমার অফুরন্ত ইচ্ছেরা পেয়ে যায় স্বর্গের ডানা।
      
   পাতার এমন মৃদু দুলে ওঠা দেখে আমার ছোটোবেলা ভেসে আসে। বটগাছের দুটো ঝুরিতে কায়দা করে দোল দোল দুলুনি, রাঙা মাথায় চিরুনি...। বর টর আসতো না যদিও, তবে কুসুমদি বলতো আর দুলিয়ে দিত খুব। সে এখন এপাড়ায় থাকেনা। মেয়েদের বড় হয়ে গেলে যে অন্যপাড়ায় চলে যেতে হয়! কুসুমদির কাছে শুনেছি, আমি তখন খুব ছোটো, হামাগুড়ি ছেড়ে ওই হাঁটতে শিখেছি সবে। খেলতে খেলতেই নাকি এক্কেবারে পুকুর  পাড়ে। ঝুঁকে পড়ে কিছু খুঁজছিলাম। নিজের ছায়া? জানিনা। ছায়া কি সকলকে এভাবেই টানে? হয়তো ডুবেই  যাচ্ছিলাম। তখন তো  সাঁতার জানি না। একটি হাত এসে আমায় টেনে ধরে। কুসুমদি...
        এরকম ছাপোষা কত জীবন কতভাবেই তো হাবুডুবু খায়। এমন করে যদি টেনে তোলার কেউ থাকতো, কত জীবন কত রোমাঞ্চ ছুঁয়ে যেত তাহলে। এই জল এই পুকুর নাকি আমায় টানে! কতবার যে ডুবে গেছি, তারপর ভেসে উঠেছি  আবার...পুনর্জন্মের ছলে। সেই থেকেই আমার বাড়ি আমাকে আড়াল করে রেখেছে ওই জল থেকে ওই পুকুর থেকে। চোখের আড়াল করলেই কি মনের আড়াল হয়? জল ডাকে, তার ওই হাল্কা কেঁপে ওঠা উপরিভাগ  প্রেমিকার উন্মুখ ঠোঁটের মতো মনে হয়। মনে হয় অবগাহন করি। যাওয়ার রাস্তা নেই। ওই একমাত্র উত্তুরের জানলা দিয়েই চোখ ছুঁয়ে আসে সে সব কোমল অধররাশি।

         সন্ধে নামে। হাই তুলতে তুলতে বুজে যায় শিরীষের অজস্র পাতার চোখ। দু একটা পাতা আধো আধো ঘুমে দেখে নেয় ফিরেছে কিনা বান্ধব পাখি সকল। তারপর  সকাল হয়। জানলা দিয়ে আসে  সুবাস। আমি চোখ মেলে দেখি তার সবুজে সাজানো সংসার।
   তবে ঝড় বৃষ্টির দিনে অভিমান দেখেছি শিরীষের। গর্জন করে রাগে, ভয়ে। ঝাপটা মারে। জানলার পাল্লায় ধাক্কা দেয়। ভেতরে ঢুকতে চায়। নীচ থেকে মায়ের চিৎকার–'ও রে জানলাটা বন্ধ কর, ঝড়ে ভেঙে যাবে যে'। মন চায় না, তবু বন্ধ করি । কিছুক্ষণ পর খুলে দেখি– ভেজাচোখে মুখ নীচু। কী করি বলোতো শিরীষ, মা যে বকতো।  আর হ্যাঁ শোনো– মা কিন্তু তোমাদের মোটেই  দোষ দেয়নি, বলেছে–ঝড় নাকি জানলা ভেঙে দেবে!
শিরীষ হাসে না, এলোমেলো হয়ে স্থির হয়ে ঝুঁকে থাকে। আর আমার ঘরময় ছড়িয়ে থাকে তার খসা  পাতা। মানুষের ছেলেমেয়ে আমরা। কী করে শুনি বলো তোমার ওসব খসাপাতার কান্না!

          যত দিন যায় পশ্চিমের এই ঘর, উত্তরের এই জানালা আমায় ছাড়ে না। আমিও কি ছেড়েছি! জানলায় কত অক্ষর ওড়ে, প্রজাপতির মতো। তাদের অনুনয় বিনয় করি। আঙুলে ধরে খাতায় এনে বসাই। তারা শোয়। ঘুমোয়। আর আমাকে জাগিয়ে রাখে। শিরীষের ছায়া পড়ে জলে। জল কাঁপে। শিরীষের ছায়া আমায় ডাকে...আয় আয়। সেই জল সেই কাঁপন! ছেলেবেলার সেই ঝুঁকে পড়া আবার ফিরে আসে। আমায় টেনে নিয়ে যায়...
    ডাক্তার আসে। ওষুধ দেয়, বলে–এসব মায়া।  জানলার অসুখ। ছায়া টানে , জল টানে। উপেক্ষা করতে পারি কি? গতবছর  কাঁদতে কাঁদতে মা আমার দরজায় তালা ঝুলিয়ে গেছেন। আমি এখন ঘরেও না, বাইরেও না। তবে কোথায়!

একক কবিতা সন্ধ্যা



মহুল ওয়েব প্রকাশিত বিভিন্ন সংখ্যা



করোনা Diary



আমাদের কথা

আমাদের শরীরে লেপটে আছে আদিগন্ত কবিতা কলঙ্ক । অনেকটা প্রেমের মতো । কাঁপতে কাঁপতে একদিন সে প্রেরণা হয়ে যায়। রহস্যময় আমাদের অক্ষর ঐতিহ্য। নির্মাণেই তার মুক্তি। আত্মার স্বাদ...

কিছুই তো নয় ওহে, মাঝে মাঝে লালমাটি...মাঝে মাঝে নিয়নের আলো স্তম্ভিত করে রাখে আখরের আয়োজনগুলি । এদের যেকোনও নামে ডাকা যেতে পারে । আজ না হয় ডাকলে মহুল...মহুল...

ছাপা আর ওয়েবের মাঝে ক্লিক বসে আছে। আঙুলে ছোঁয়াও তুমি কবিতার ঘ্রাণ...